
অনেক সময় যুদ্ধটা খুব ক্ষুদ্র পরিসরে হয় কিন্তু এটি যুদ্ধ । এই যুদ্ধে পাঁজরের হাড়গুলো সামরিক কায়দায় চেপে আসতে থাকে । ঠিক যেন প্রশিক্ষিত সৈনিক
ওরা । ওরা মানুষকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে । একটি বা একাধিক বহিঃশক্তি তখন সক্রিয় থাকে। অদৃশ্য স্থলপথে আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্রবাহী যানগুলোর গন্তব্যস্থল সেই মানুষটির ক্ষুদ্রতম আয়তনের বক্ষপিঞ্জর । কথাগুলো বলছিলেন জাহাঙ্গীর আলম স্যার । তিনি কথাগুলো এতটাই আস্তে বলছিলেন যে , কেউ কান না পাতলে শুনতে পাবেনা। কথাগুলো বলার সময় তার চোখ দুটো ভিজে উঠেছিল এবং শরীরটা চেয়ারের পেছনে কাত হয়ে পড়েছিলো । আমরা কয়েকজন দ্রুত চেয়ার ছেড়ে স্যারের কাছে এলাম । স্যার স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম স্যার ভালো নেই । কথা হচ্ছিলো ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে । ক'দিন যাবত
এ যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে সবাই কমবেশি উদ্বিগ্ন । আমরাও তাই পড়া শুরুর আগে স্যারের সাথে এ বিষয়ে দু'চার কথা বলছিলাম কিন্তু ব্যপারটা যে এভাবে মোড় নেবে ভাবতে পারিনি ।
আমরা চারজন স্যারের কাছে ইন্টারনেশনাল পলিটিক্স পড়ি। আমি সেদিন স্যারের খুব কাছের চেয়ারে বসে ছিলাম তাই দ্রুত ব্যপারটা ধরতে পারি । বাসায় এসে আব্বু আম্মুর কাছেও এনিয়ে কথা বলেছি । পরের কয়েকদিন আমরা স্যারের বাসায় গিয়েছি তবে পড়তে নয় স্যারকে দেখতে । স্যার খুব স্বাভাবিক আচরণ করছিলেন যেন কিছুই হয়নি । আমরা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী । ইন্টারনেশনাল পলিটিক্স এবারই নতুন এ্যড হয়েছে তাই স্যার নিজেই আমাদের তার বাসায় এসে পড়তে বলায় আমরাও উৎসাহিত হই । আসলে স্যারের জানার পরিধি এতো ব্যপক এবং প্রকাশের ভঙ্গি এতো চমৎকার যে আমরা অনেকটা স্যারের প্রেমেই পড়ে গেছি । স্যার বইয়ের গন্ডি পেরিয়ে সাম্প্রতিক বিষয়াবলী এবং এর সাথে আমাদের দেশের অবস্থান নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণে চলে যান । আমরাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনি । আমাদের কাছে মনে হয় স্যারের কাছেই পৃথিবীর সমস্ত সংঘর্ষের পূর্ণ সমাধান রয়েছে ।
কয়েকদিনের মধ্যেই স্যারের বিষয়টা ক্যম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকদের নির্বাচনোত্তর সেমিনারে স্যারের বক্তব্যে নাকি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্যসব দলীয় শিক্ষকরা । শুধু তাইনা তারা স্যারের অপসারণও দাবি করেছেন । স্যার নাকি শিক্ষকদের অতিমাত্রায় রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন ।অ্যডহক ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষকের অমন ডেম্পকেয়ার আচরণ কেউ মেনে নিতে পারছেন না ।
স্যারের অন্ধভক্ত আমরা সবাই একত্রিত হলাম । আমাদের মাঝে সেতুই ছিলো কোঅর্ডিনেটরের ভূমিকায় । এই পর্যন্ত ঠিকই ছিলো কিন্তু সেতুর অতিরিক্ত গোয়েন্দাগিরীতে আমার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে । সে ঘনঘন স্যারের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছে । আমাদের অনুপস্থিতিতে স্যার আর সেতুর মাঝে কী কথা হয় জানাটা জরুরী হয়ে পড়ে ।আমরা স্যারের গৃহপরিচারিকা বিথীর মায়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলাম ।প্রতিদিন কাজ শেষে যাওয়ার পথে সে আমাদের কাছে রিপোর্ট করবে । পারিশ্রমিক নগদ । নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ক্যম্পাস ততই উত্তপ্ত হচ্ছে । দলীয় ক্যাডাররা সেজে উঠেছে । আমি সেতুকে ইশারা ইঙ্গিতে বুঝাতে চেষ্টা করলাম পরিস্থিতি সুবিধার মনে হচ্ছেনা - সময় থাকতে সরে পড়ো । সেতু খুব ছোট করে উত্তর দেয় - ভেবোনা ।
বিথীর মায়ের ভয়াবহ সব রিপোর্ট ভাইরাল হয়ে
গেলো । স্যারের বিরুদ্ধে পূর্বের আনীত অভিযোগের সাথে যুক্ত হলো নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা । সেতু এ ব্যপারে পুরোপুরি আমাকে দোষারোপ করলো । আমি সেতুকে পাল্টা অভিযোগ করি - তোমাকে ভালোবাসি বলেই সাবধান করেছিলাম বিনিময়ে ঘাড়ে লাথি খেলাম।
স্যারের অপসারণ এখন সময়ের ব্যপার । সেতুর মগজে সামান্য বুদ্ধি থাকলেও সে ঘটনার প্রধান সাক্ষী হবে , না হলে যে তার স্কলারশিপ বাতিল হবে এমনকি বহিষ্কৃতও হতে পারে ।
ইতোমধ্যে ক্যম্পাসে আমাদের আলাদা একটা পরিচিতি এসে গেছে - আমরা নির্দলীয় । এই পরিচিতিই আমাদের ভাগ্য খুলে দেয় । সবাই চেষ্টা করছে আমাদেরকে যার যার দলে ভিড়াতে । আমরাও যেখানে সুবিধার পাল্লা ভারি সেখানেই ভিড়ে গেলাম । প্রক্টর স্যার , ভিসি স্যারের বাসার সামনে আমাদের অবস্থান । বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছি কিন্তু সেতুর জন্যে মন কেমন করছে । প্রায় সপ্তাহ হতে চলছে তার পাত্তা নেই । অমন কঠিন সিচুয়েশনে স্থির আছে কিভাবে তাই ভাবছি । ভাবতে ভাবতেই ঘটনা ঘটে গেলো । সেতু আসছে হ্য আমাদের দিকেই আসছে পেছনে বিথীর
মা । মনে মনে বিথীর মাকে থ্যাংকস দিলাম - সি ইজ প্রমিজিং । ভেতরের অস্থিরতা আর চেপে রাখতে পারলাম না । একটা অট্টহাসি দিয়ে বন্ধুদের দেখিয়ে বললাম ওই দ্যাখ কান টানলে কিভাবে মাথা আসে ।
সেতু মুচকি হাসি দিয়ে একটা খাম আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে - এই নাও আমার বিয়ের কার্ড । ব্যপারটা বুঝতেই অনেকটা সময় চলে গেলো । জাহাঙ্গীর আলম স্যারের সাথে সেতুর বিয়ে !
চোখে সরিষার ফুল দেখছি । তারপর একে একে স্যারদের বিকৃত মুখগুলো সব একসাথে সামনে এলো । যুদ্ধটা কোথা থেকে কোথায় গড়াচ্ছে তাহলে !
সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটা শুরু হলো আমার নিজের সাথে নিজের ।
0 মন্তব্যসমূহ