বাড়ি - অরুরিমা সিনহা

সজলবাবুর মস্তোবড়ো বাড়ি আজ যেন শুন্য হয়ে পড়ে আছে। একসময় এতই চিৎকার হত যে, বাড়িতে কাক ,চিল, বসা বন্ধ করে দিয়েছিল। সজলবাবু একদম চিৎকার-চেঁচামেচি সহ্য করতে পারতেন না তাই তিনি তার ছেলেমেয়েদের খুব শাসন করতেন। কিন্তু সজল বাবু স্ত্রী নয়না দেবী তার ছেলে মেয়ে চিৎকার বদমাশি গুলোকে খুব প্রশ্রয় দিতেন। নয়না দেবী খুব পছন্দ করতেন তার ছেলে মেয়ে তার বাড়িঘর কে জমজমাট করে  রাখুক। এদিকে সজল বাবু একদমই চিৎকার-চেঁচামেচি পছন্দ করতেন না। সজল বাবু ব্যাংকে চাকরি করতেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাব শিষ্য ছিলেন ও  মনে মনে।  তাই রবীন্দ্রনাথের বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে খুব ভালোবাসতেন আর নিজেও টুকিটাকি লেখালেখি করতেন । তিনি তার বেডরুমের আলমারিতে জামাকাপড়ের বদলে বইপত্র রাখতেন এই নিয়ে নয়না দেবীর সাথে রোজ দ্বন্দ্ব। তিনি সারাদিন চাকরি করে সন্ধ্যেতে এইসব নিয়ে বসতেন কিন্তু ছেলে-মেয়েদের উপদ্রবে এসব নিয়ে একটু ভাববেন তারও উপায় ছিল না। তাই রোজ সন্ধ্যায় চা খেয়ে বেরিয়ে যেতেন বন্ধুর সঙ্গে দিঘির পাড়ে। সজলবাবু রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করতেন  বাড়ির একটু দূরে একটা দীঘি ছিল সেখানে সন্ধ্যার সময় স্ট্রীট লাইটের আলোয় সন্ধ্যাকালীন সাদা ফুলের সুবাসে  । তার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন তার ছোটবেলাকার বন্ধু শ্যামা কে যদিও তার পুরো নাম ছিল শ্যামাপদ চক্রবর্তী তিনি আদরে শ্যামা বলে ডাকতেন । যিনি ছিলেন বাংলার অধ্যাপক এই শ্যামাপদ বাবুর সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথের প্রতি এত টান জন্মেছিল সজল বাবুর  গাছের শিকড়ের সঙ্গে মাটির যেমন। ছোট থেকে সজল বাবু গল্প, উপন্যাস ,কবিতা , পড়তে খুব ভালোবাসতেন কিন্তু ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার দরুন সজল বাবুর বাংলাটাকে দূরে ছুঁড়ে দিতে হয়েছিল অনিচ্ছাকৃতভাবে। সজলবাবুর বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী কমার্স নিয়ে পড়ে ছিলেন তাই আজ তিনি ব্যাংকের ম্যানেজার মাথায় হাজার চাপ থাকা সত্ত্বেও, শত ব্যস্ততার মাঝেও সন্ধ্যাকালীন দিঘির পারে বন্ধুর কাছে এসে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে বড্ড ভালোবাসতেন। দিঘির পাড়ে দুই বন্ধুর বাংলা সাহিত্যকে ঘিরে এত আলোচনা প্রশান্তির বার্তা নিয়ে আসতো দুই বন্ধুর মনে। এভাবে তাদের কখন সন্ধ্যা থেকে রাত গড়িয়ে যেত তা তারা বুঝতে পারতেন না। বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুজন বন্ধুর প্রায় রাত এগারোটা বেজে যেত। দুই বন্ধুর যখন গল্প শেষ হত শ্যামাপদ বাবু সজল বাবুকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে আসতেন। তারপর শ্যামাপদ  বাবু বাড়ি গিয়ে রান্না বসাতেন কারণ শ্যামাপদ বাবু বিয়ে করেননি। বাড়িতে বিধবা মা, ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী ও ছেলে মেয়ে, থাকতেন। তা সত্বেও শ্যামাপদ বাবু নিজে রান্না করতেন কারণ রোজ রোজ কে রান্না করে দেবে? তিনি তার বিধবা মাকে একেবারে কষ্ট দিতে চাইতেন না তাই নিজের হাতে রান্না করতে খুব পছন্দ করতেন। সজল বাবু যখন বাড়ি ফিরতেন ছেলেমেয়েগুলো ঘুমিয়ে পড়তো সজল বাবু যেন শান্তি অনুভব করতেন । প্রতিদিন নৈশ ভোজ শেষ করে একটা উপন্যাস বা গল্প পড়তেন। কিন্তু তিরিশ টা বছর অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে তার বাড়িতে। ছেলেমেয়েগুলোর জ্বালায় যে সজল বাবু বাড়ি ফিরতেন না আর সেই বাড়ি ফিরতে তার আর মন চায় না। কারণ যে বাড়িতে একদিন পায়রা,   কাক, চিল, বসতে ভয় পেত আজ সেই বাড়িতে সেই কাক, পায়রা ,চিলের বাসা। আজ শুধু কাক পায়রা ,চিলের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দই যেন  সজল বাবুর কানে এসে পৌঁছায় না। সেই প্রাণেররবি ঠাকুরের যেন আজ কেমন একঘেঁয়ে হয়ে গেছে । যার গল্প-উপন্যাস ছাড়া সজল বাবুর সময় কাটতো না আজ সেই প্রাণের রবি ঠাকুর অনেকটা কেমন যেন দূরে সরে গেছে। তিরিশ বছরের কেটে যাওয়া মুহূর্তগুলো আজ শুধু মনকে নয় সজল বাবুর বাড়িটাকে অনেকটা পরিবর্তন করে দিয়েছে। কারণ এখন সজল বাবু এক ছেলে আজ সে বিদেশে ,দুই মেয়ের মধ্যে দুজনেই বিবাহিতা একজন চাকরি সূত্রে বাইরে রাজ্যে।  বাড়ির কাছে থাকা সত্বেও ছোটো মেয়ে একান্নবর্তী পরিবারের  নিজের সংসার ছেড়ে আসার সময় হয় না বাবা মায়ের কাছে থাকতে।
এদিকে নয়না দেবী ফেলে আসা তিরিশটা বছরের স্মৃতি নিয়ে বসে আছে,  চোখের জল কখন যে গড়িয়ে যাচ্ছে নিজে বুঝতে পারছেন না। আজ পুরো বাড়ি জুড়ে এক অদ্ভুত রকমের একাকীত্বতা যা  অসহনীয় হয়ে উঠেছে। তাই তিনি রোজ সন্ধ্যার সময় মঠে চলে যান। এদিকে সজল বাবু তিরিশ বছরের ফেলে আসা স্মৃতি বুকে জড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে ঘড়ির কাটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। সময় এগারোটা মনে পড়ছে তিরিশ বছর আগেকার সেই দিনের কথা ঠিক এই সময়ে সজল বাবু একটা শান্তি অনুভব করতেন কারণ ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়তো। আজ যে এগারোটা  বাজলে তার মনের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়। আজ তার বন্ধু শ্যামাপদ  চক্রবর্তী কাছে নেই তিনি চাকরিসূত্রে কলকাতায় চলে গেছেন কলকাতা তিনি একাই থাকেন তাঁর মা দশ  বছর মারা গেছেন। তাই মায়ের কথা ভেবে তিনি এই পাড়ায় থাকতেন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতেন কিন্তু তার  কোনো পিছুটান নেই তাই তিনি কলকাতায় থাকেন। ফোনে  বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় আর সবকিছু  মিলিয়ে গেছে পথের বাঁকে। সেই অতীতের মুহূর্তগুলো সজল বাবু চোখের সামনে ভেসে উঠছে বারংবার ।তিনি ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার পর বাড়ি বানিয়েছিলেন। তারপরে এক বছর পর নয়না দেবীকে বিয়ে করেছিলেন তার এক বছর পর তার বড় মেয়ের জন্ম সেই কান্নাটা যেন,   তিনি  আজ শুনতে পাচ্ছেন দোতলা ঘর থেকে। তারপর ছোট মেয়ের জন্ম সজল বাবু চোখে জল এনে দিয়েছিল তারপর বহু কাঙ্ক্ষিত সেই মুহূর্ত যখন তার ছেলের জন্ম হয় তিনি বাড়ি জুড়ে উৎসব করেছিলেন। তারপর ছেলেমেয়েগুলো বড় হওয়ার সাথে সাথে যে যার নিজের রুম চিহ্নিত করে ফেলেছিল বড় মেয়ে থাকতো সিঁড়ির ঘরের রুমটাতে ছোট মেয়ে থাকতো তার পরের রুমে আর ছেলে থাকতো বারান্দা পাশের রুমে ছেলের বারান্দা খুব পছন্দ ছিল সেই বারান্দায় কত গাছ লাগিয়ে রাখতো আজ  সেই গাছ নেই‌ ,যেন সব মরুভূমি ।তিরিশ  বছর আগেকার এই বারান্দা আজকের বারান্দা বিস্তর ফারাক। এই ভাবে তিরিশ বছর আগেকার স্মৃতি বুকে নিয়ে তাকিয়ে আছে মস্ত বড় বাড়িটার দিকে সজল বাবু..।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ