অভিজিৎ দাস
সুরঞ্জন
চক্রবর্তী । বয়স ২৭ । এম.এস.সি. পাশ । টেট পাশ করে চাকরিতে ঢুকেছে । চাকরির ইচ্ছে
ছিলনা, কিন্তু এছাড়া আর উপায়ও ছিলনা, অগত্যা চাকরিতে ঢুকতে হল । ইচ্ছে ছিল নিজের
একটা ব্যবসা খাড়া করবে, কিন্তু হাতে যথেষ্ট টাকা না থাকায় ভাবল কয়েকবছর চাকরি করে
তবেই নাহয় ব্যাবসায় নামবে । একটা গোপন সখ আছে, সখ না বলে জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ
লক্ষ্য বলা যায় । কবিতা লেখা । কবিতা নয়, শিল্প সৃষ্টি । প্রতিদিন ছ’সাত ঘণ্টা শিল্পকে দেয়, কিন্তু
কিছু করেই কিছু হচ্ছেনা । ইদানীং ভিসুয়াল আর্টের সাথে কবিতাকে মিশিয়ে কি সব
এক্সপেরিমেন্ট করে । একটা বই করেছিল, বছর ছয়েক আগে, পাণ্ডুলিপি স্ক্যান করে ছাপিয়ে
দিয়েছিল । পাণ্ডুলিপিও এমন, ছোট ক্লাসের দুষ্টু ছাত্ররা নোটবুকের যে হাল করে রাখে
সেরকম । তখন ভেবেছিল, অনেক বড় কিছু একটা করে ফেলেছে । বাংলা ভাষার খ্যাতিমান সব
কবিদের ঠিকানায় পাঠিয়েছিল সে বই, বইটির মধ্যে পাঠযোগ্য কিছু থেকে থাকলে তা হচ্ছে
ভূমিকাটা, “...যান্ত্রিক অক্ষরে কবিতার কতটা ধরে রাখা যায় ? ইমিটেশন ! ইমিটেশন !
শুধু
শব্দ নয়, প্রত্যেকটা কাটাকুটি, বানানভুল, আর যা কিছু কবিতা লিখতে গিয়ে চেতন ও
অবচেতন ঘটায়, সবটাই কবিতা । সেই কবিতাকে তুলে ধরতে হবে পাঠকের কাছে । যান্ত্রিক
বর্ণে কবিতা আর নয় ।...” কিন্তু, কোন বিশেষ কারনে তার বইটি কারো পছন্দ হয়নি, তার অনুকরণে কেউ পাণ্ডুলিপি
স্ক্যান করে বইও ছাপায়নি ।
আজ তার চাকরিতে
জয়েন করার দিন, গ্রাম থেকে আট কিলোমিটার দূরে মহকুমা শহরের একটি স্কুলে । পৌঁছে
গেল সাড়ে দশটাতেই । স্কুল তার পছন্দ হয়নি । স্কুল-কলেজ জিনিসটা তার কখনোই পছন্দের
নয়, আর এখানেতো মূর্খ মূর্খ গন্ধ । সুরঞ্জনের মেজাজ গেল চড়ে । মূর্খ মূর্খ গন্ধ,
বিশেষ এক ধরনের গন্ধ । সবাই পায়না, কিছুটা ভুতের গায়ের গন্ধের মত । সবাই পায়না,
কেউ কেউ পায় । সুরঞ্জন পায়, হতে পারে শুধু সুরঞ্জনই পায় । মূর্খ মূর্খ গন্ধ
মোটামুটি সব স্কুলেই কমবেশি থাকে, অন্তত সুরঞ্জন সেরকমই পেয়ে আসছে । স্কুলের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে অব্দি এই
গন্ধ নাকে এসে কেমন কেমন করে । সুরঞ্জন ভেবে পায়না এর কারণ, শিশুদের জ্ঞান কেন এই
মূর্খ মূর্খ গন্ধটাকে মেরে ফেলতে পারেনা ? খুব সম্ভবত জ্ঞানের কোন গন্ধ হয়না;
জ্ঞানের এক রকম জ্যোতি থাকে যা দিয়ে অন্ধকার দূর করা যায়, গন্ধ দূর করা যায়না ।
মেজাজটা আরও খারাপ হয়ে গেল, যখন বেসুরো জাতীয় সঙ্গীত শুরু হল । জাতীয় সঙ্গীত শেষে
হেডমাস্টার মশাই সুরঞ্জনকে পরিচয় করিয়ে দিলেন ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
সাথে । মুখে হালকা মেকি একটা
হাসি ধরে রাখল সে । আজকের জন্য সুরঞ্জনকে দুটি ক্লাস দেওয়া হল, দুয়েকদিনের মধ্যে
রুটিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে ।
ক্লাস দুটো নিল
। তারপর ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে এল । করবে কী ? এমন দুর্গন্ধে মানুষ থাকতে পারে নাকি ?
কে পারে আর কে পারেনা এসব ভাবার সময়ইবা কোথায় ? ইস্কুল থেকে কিলোমিটার খানেক দূর
যেতে মনে হল প্রান ফিরে পেয়েছে । হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লো, উঠল রাত ন’টায় । হালকা জ্বর । মা খিচুড়ি করে
দিলেন, খিচুড়ি আর লিটার খানেক জল খেয়ে শুয়ে পড়ল আবার । জেগে থাকতে পারছেনা, জেগে
থাকতে ভয় করে, যদি সে গন্ধ নাকে আসে ফের । কী হবে ? উফফফ !
পুরো সপ্তাহ
বাড়িতেই কাটিয়ে দিল । স্কুল মুখো হলনা আর । মা বারবারই জিজ্ঞেস করছেন, কী হয়েছে ? কি যে হয়েছে তা কি আর বলা যায় ? পাগল
ছাড়াতো কিছু ভাববেননা ! সুরঞ্জনকে ধরল তখন এক্সিস্টেনশিয়ালিজম-এর রোগে, কি যে করবে
আর কি যে করবেনা ভেবে পাচ্ছিলনা । চাকরিটা কি তাহলে ছেড়ে দেবে ? কিন্তু চাকরিটা
পাওয়ার জন্য বেশ খানিকটা কষ্ট করতে হয়েছে ওকে, মাসখানেক লেখাপড়া করতে হয়েছে শুধু
টেট পরীক্ষার জন্য । আর চাকরি ছেড়ে দিলে এখন করবেই বা কী ?
আকাশ-পাতাল
ভাবতে ভাবতে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে ঝোঁকের বশে সোমবারে চলেই গেল স্কুলে । পকেটে
এক প্যাকেট ন্যাপথালিন নিল । ঠিক করল যথাসম্ভব সহকর্মীদের এড়িয়ে চলবে । গন্ধটা
মুলত ওদের মগজ থেকেইতো আসে।
লাভ হলনা কিছু
। অসহ্য । কিন্তু সুরঞ্জনও ছাড়ার পাত্র নয়, গন্ধ ! কিসের গন্ধ ! সামান্য গন্ধকে ভয়
পেলে চলবে কেন ? অবশেষে নিজেকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঢুকে পড়ল গিয়ে স্টাফ রুমে । ওখানে
কথা বলছিলেন ফিজিক্সের শিক্ষক, শুকুর মিঞা, ফিজিক্স কেন গুরুত্বপূর্ণ, ফিজিক্সের
কাছে আর সব বিষয় কিছুই নয়, ফিজিক্স ছাড়া কিচ্ছু হয়না... এইসব নিয়ে লম্বা লেকচার
দিচ্ছিলেন । একমাত্র অবিচ্ছিন্ন স্রোতা বাংলার শিক্ষক, ভুত্রাম, বাকিরা কেউ কখনো
শুনছে কখনো মোবাইল দেখছে, কেউবা আসতে আস্তে কথা বলছেন কারো সাথে টেলিফোনে, একজন
আবার অনলাইনে শত্রু নিধনও করছেন । সুরঞ্জনের কেমন ঘোর লেগে গেল । বমি আসছে, সারা
শরীরে ব্যাথা করছে, উফ, কি যন্ত্রণা ! হোক যন্ত্রণা । সুরঞ্জন একটা চেয়ার টেনে বসে
পড়ল । সুরঞ্জনের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে অন্য এক সুরঞ্জন । গন্ধের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে ওপেন
চ্যালেঞ্জ, হয় তোর একদিন না হয় আমার একদিন ...
ফিজিক্স বাবুর
লেকচার তখন বিজ্ঞানের গণ্ডি পেড়িয়ে চলে এসেছে শিল্প সাহিত্যের দিকে । এটাই প্রমান
করতে চাইছেন যে, শিল্প-সাহিত্য হচ্ছে জঘন্য একটা জিনিস, এসব নিয়ে সময় নষ্ট করার
কোন মানে হয়না । এমনই বংশানুক্রমে পাওয়া কথাগুচ্ছ বলে যাচ্ছিলেন... হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, সুরঞ্জন । বলল, “ কী বাল বুঝিস শালা তুই বিজ্ঞানের ? শালা মূর্খ, মূর্খের গন্ধ ছড়াচ্ছিস ।
জানিস শিল্পের কাঁচা মাল যে বিজ্ঞান ? তোর মত কুকুরের সাইকোলজি জানে বলেই কপিল
শর্মা তোদেরকে হাসাতে পারে । শালা তুই জ্ঞান চুদচ্ছিস এখানে বসে... বলতে বলতেই বমি
করল সুরঞ্জন । রক্ত বমি । আর কোন কথা না বলে বাইকটা নিয়ে কোনমতে বাড়ি ফিরলো ।
শরীর ভীষণ
খারাপ করেছে, জ্বরের ঘোরে কেবল বলছে, “গন্ধ ! গন্ধ ! মাগো, গন্ধ মা । গন্ধ !...”
0 মন্তব্যসমূহ