কাঠের পাটাতনের উপরে শোয় রিপন। খণ্ড খণ্ড কাঠ একযোগে জুড়ে বহুপুরাতন পাটাতন। দাদুর আমলের। ছোট্ট ঘর। দালানকোঠা। টিনে ছাওয়া। দোচালা। বর্ষায় ফুটো টিন বেয়ে জল ছুঁয়ে যায় রিপনের শরীর। উপরে উঠার সিঁড়ি ঘরের উত্তর কোণে। কাঠের। টিভি সিরিয়ালে দেখা ঘরের মত। উপরে দুটো খিড়কি। লোহার শিক লাগানো। গরমকালে খিড়কি খুলে ঘুমায়। ঠাণ্ডা বাতাসে ঘুম লাগে চোখে। উপরে পাখা লাগানোর মত উচ্চতা নেই। নীচে শোয় বাবা ঠাম্মা আর ছোটবোন।
পাকা ঘাটলাটা দেখা যায় পাটাতনের খিড়কি দিয়ে। বড়দাদাজান শখ করে বাঁধিয়েছিলেন পুকুরঘাট। শ্যাওলা সবুজে ছাওয়া। বার্ণিশ রঙের মত উজ্জ্বল। ঘাটলা ধুয়ে দিচ্ছে চাঁদছটা। খিড়কি খোলা। রিপন ঘুমায় নি। গাঁয়ের বিছানায় মধ্যরাত। নিঝুম ঘুমে ছাওয়া। ঘুম জড়ানো কিছু পাখী মাঝে মাঝে পাখপাখালী করে উঠে। আবার ঘুমে ঢুলে। পুকুরের ঘোলা জলে ঠাম্মার চন্দনী রাইত খেলে যাচ্ছে।
রিপন ঘুমজাগা। অক্ষিকূট খিড়কি ওপাড়ে। কুচকুচে ঠান্ডা শরীরের রোম স্পর্শ করে যায়। মনখারাপের বাড়িরাখালের মত পাহাড়া দিচ্ছে আকাশ থেকে উঠোন। পানসে লাগছে প্রকৃতির পোয়াতী আবেদন।
মায়ের হাতে হাত লাগানো মাস তিনেকের ঘামঝরানো মাটিকথা মনআলয় নাড়া দিচ্ছে বারবার। মা বহুদিনের পরে নিশ্চিন্ত ঘুমে রাত কাটাচ্ছেন। কত ঘুমহীন রাত। কাজের তাড়া। কুপি আলোয় ঢিমে উঠোন। রিপন মায়ের সঙ্গী। মুসলিম মায়ের ছেলের শরীরে মায়েরই তো রক্ত। হিন্দু দেবদেবী নিজের হাতে গড়তে শিখেছেন দাদাশ্বশুরের কাছে। চুপি চুপি। শ্বাশুরী প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছে প্রথম প্রথম। বৌয়ের সাথে যুদ্ধে জিততে পারে নি। নাছোড়বাধা। সমাজের চোখে সর্ষে তেল ঢেলে নিজের মনকে জয় করেছে।
মায়ের গড়া মুর্তিকে সাজিয়ে শেষ রূপ দিতে ভালোবাসে রিপন। আবেগ জড়িয়ে। ভোরের শীতলতার মত কোমল হাতে সাজায় ঠাকুর প্রতিমা। মনের মত করে। মা চেয়ে চেয়ে দেখেন ছেলেকে। চৌকাঠে বসে।
সব ঠাকুর প্রতিমা রিপনকে ছেড়ে ভক্তের ঘর আলো করেছে। আড়ম্বরে। বাতির ঝলমলানিতে। কয়েক সপ্তাহের ঘুম এসে ভীড় করেছে মায়ের চোখে। রিপন চেয়ে আছে আনমনে। পুকুরের ঘাটলায়। মনের গভীরে টানাপোড়ন। চাঁদটা ক্রমশ গোলাকার হয়ে উঠছে। এমন লোভনীয় চাঁদের চাইতে গতরাতের চাঁদ বেশি সুখের ছিল। উঠোনের আলো আধারীতে মিশে গেছে রিপন। চাঁদ জেগে উঠেছে।
0 মন্তব্যসমূহ